মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং অন্তরায় সমূহ

520

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং অন্তরায় সমূহ

প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার মূল ভিত্তি। এটি আমাদের মৌলিক অধিকারও বটে। প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এখন সময় এসেছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের। প্রাথমিক শিক্ষার মূল ভিত্তি মজবুত না হলে শিক্ষার অন্যান্য স্তরে কাঙ্খিত ফল আশা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আর এটি যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা চরমভাবে ব্যহত হবে। আমরা হয়তো ধাপে ধাপে একদিন উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারব, কিন্তু মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে সে অর্জিত উন্নয়ন আদৌ টেকসই হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সুতরাং এসডিজি

(Sustainable Development Goal) অর্জনে গুণগত অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা ব্যতীত আর কোন বিকল্প নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা বলতে কী বুঝায়- যে শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড জাগ্রত করে এবং তার আবেগিক ও মনপেশিজ তথা সৃজনশীলতা চর্চার মাধ্যমে চরিত্রের ইতিবাচক পরিবর্তন করে সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে দক্ষ ও যোগ্য করে তোলে, সেই শিক্ষাই হলো মানসম্মত শিক্ষা।
বর্তমান সময়ে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক/শিক্ষিকা নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন চলমান এবং ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা অনুপাতে স্লিপ গ্রান্ড ফা- অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। তারপরেও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আসলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে বেশ কিছু অন্তরায় কাজ করছে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই পেশায় আসতে অনীহা প্রকাশ করছে। শিক্ষকদের বেতন ভাতা, সামাজিক সুবিধা ও মর্যাদা এত কম যে, কেউই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহ দেখায় না। আর যারা আছেন তারাঁ খুবই হতাশা গ্রস্থ। তাছাড়া শিক্ষক বদলী, মাতৃত্বকালীন ছুটি, নৈমিত্তিক ছুটি, মেডিকেল ছুটি প্রভৃতি কারণে শিক্ষক শূণ্য থাকার কারণেও প্রাথমিক শিক্ষার মান ব্যহত হচ্ছে। এছাড়াও প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকদের বিভাগীয় কাজের বাইরেও তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন জরিপ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোট গ্রহণ, উপবৃত্তি সিউর ক্যাস ফরম পূরণ, মাস্টার রোল ও তার চাহিদা তৈরি ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক কাজে নানামূখী কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাও নানাভাবে বিঘিœত হয়। অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিকে ২০১৮ সালের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০ অর্জনের লক্ষ্য স্থির থাকলেও সে লক্ষ্য থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অনেকটা দূরে অবস্থান করছে। যদিও অনেক বিদ্যালয়ে এই চিত্র ভিন্ন। বিদ্যালয়ের অবস্থানের সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায় বেশিরভাগ শিক্ষাথী টিফিন পিরিয়ডের পরর্ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছে । অনেক অভিভাবক এত দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থানকে নেতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে। যেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো শুরু হচ্ছে দেরীতে আবার শেষ হচ্ছে আগে। অনেকে মনে করছে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি এটা এক ধরণের মানসিক নির্যাতন- যা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের অন্তরায়। আবার শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও মূল্যায়নের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। শিক্ষাক্রমের অনেক অংশ অস্পষ্ট এবং পাঠ্যপুস্তকে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর অনুপস্থিতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। প্রাথমিক শিক্ষার নিম্নস্তর অতিক্রম করতেই দুইটি পাঠ্যবই থেকে ছয়টি পাঠ্যবই অনেক শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে দূর্বল করে দেয়। আবার শিখন শেখানে কার্যক্রম দক্ষতার সথে পরিচালনা করতে প্রদেয় প্রশিক্ষণগুলো প্রদান করে প্রাথমিক শিক্ষার প্রশিক্ষণ বিভাগ। অন্য দিকে এটি মনিটরিং এর দায়িত্বে থাকেন প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন বিভাগ- যা অনেক ক্ষেত্রে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিকরণে বিঘœ সৃষ্টি করছে। অনেক বিদ্যালয়েই ছোট শ্রেণিকক্ষে অনেক শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে বসে পাঠ গ্রহণ করতে হয়, এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই অনভিপ্রেত সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। এ সমস্থ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রশাসন, যোগ্য শিক্ষক মন্ডলী ও কারিকুলামের উপর নির্ভর করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব। এমতাবস্থায় এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণ ব্যতীত মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। সুতরাং এই মহান পেশার দিকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে করতে হবে। শিক্ষকতা অন্যান্য পেশার রোল মডেল। একজন শিক্ষক মনুষ, সমাজ ও জাতি গড়ার কারিগর। একটি উন্নত ও আদর্শ রাষ্ট্র গড়ার জন্য চাই একজন গুনগত মানসম্মত শিক্ষক। শিক্ষকদের বেতন ভাতা, সামাজিক সুবিধা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। আর শিক্ষকমন্ডলীদের পাঠদান কাজের বাইরে অন্যান্য কাজে সংযুক্ত করা থেকে বিরত রাখতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০ অর্জনের লক্ষ্য স্থির রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন সাধন করতে হবে। বিদ্যালয়ের সময়কাল সংক্ষেপ করতে হবে। শিক্ষাবিদ দ্বারা প্রদেয় গবেষণালব্ধ রুটিন এক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা প্রদান করতে পারে। সময়পোযোগী শিক্ষাক্রম ও মানসম্মত পাঠ্য বই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। আর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের পূর্বেই পেশাগত প্রশিক্ষণ যেমন, সিইনএড, ডিপিএড, বিএড, এমএড ইত্যাদি সমাপ্তকরণের পরেই নিয়োগ প্রদান করলে শিক্ষক সংক্রান্ত শূণ্যপদ সমস্যার সমাধান হতে পারে। অন্যদিকে প্রমোশন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে একটি নির্দিষ্ট পদ পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রমোশন প্রদান শিক্ষকতা পেশার প্রতি মোধাবী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও আইসিটিলব্ধ জ্ঞান (মাল্টিমিডিয়ার) মাধ্যমে পাঠদান শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে খেয়াল রাখতে হবে সাবলিল পাঠক তৈরি করতে না পারলে কখনোই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। সর্বোপরি ক্যাচমেন্ট এরিয়ার কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে এবং শিক্ষকমন্ডলীদের পেশার প্রতি অধিক শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই কেবল মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ সম্ভব।

মোঃ সুলতানুল আরেফীন
সহকারি শিক্ষক
গুরুদাসপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
গুরুদাসপুর, নাটোর।

E-mail: s.arefin19@gmail.com Web: educationtune.com

Leave A Reply